মেডিকেলের সেকেন্ড টাইমের জন্য কিভাবে প্রস্তুতি নেব?

মেডিকেলের সেকেন্ড টাইমের জন্য কিভাবে প্রস্তুতি নেব?

ছোটবেলায় স্কুল জীবনে যতবারই "Aim in Life" প্যারাগ্রাফ লিখতে হয়েছে, বুঝে না বুঝে প্রায় সবাই জীবনে অন্তত একবার "My aim in life is to be a doctor" লিখে দিয়ে এসেছে। গ্রামাঞ্চলের অভিভাবকরা এখনো নিজেদের সন্তানকে ডাক্তার বানানোর মধ্যে বিশাল এক সফলতা দেখতে পায়, শিক্ষার্থী ভালো হলেই "তাকে ডাক্তার হতে হবে" টাইপ চিন্তা চলে আসে গ্রামাঞ্চলের সেই শিক্ষার্থীর বাবা, মা, জ্ঞাতিগোষ্ঠী, স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে পুরো গ্রামের মুরুব্বিদের মধ্যেও। জোর করে চাপিয়ে দেয়া এই ইচ্ছার বাইরেও এমন অগণিত শিক্ষার্থী আছে যাদের জীবনের লক্ষ্য ডাক্তার হওয়া, বুঝে শুনেই ডাক্তার হওয়া। এই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণের জন্য এইচএসসির পর সরকারি বা বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি হওয়াটা মাস্ট। (ডেন্টিস্ট হওয়ার জন্য ডেন্টাল কলেজ/ডেন্টাল মেডিকেল কলেজ।) তাই এইচএসসি শেষ করেই এই শিক্ষার্থীরা শুরু করে সরকারি মেডিকেল ভর্তির সুযোগ পেতে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি। একটাই পরীক্ষা, একটাতেই নির্ধারিত হবে এবছর সাদা অ্যাপ্রোন গায়ে জড়ানোর সুযোগটা আসবে কি না। না আসলে অপেক্ষাটা আরও এক বছরের।

এই আরও এক বছর অপেক্ষা করাটা অনেকের জন্যই সম্ভব হয় না। অনেকেই ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলে, হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, মনোবল ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়। আবার অনেকেই নিজের উপর পূর্ণ আস্থা রেখে পুরো বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়ে বীরের মতো করেই দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় নিজের করে নেয় সরকারি মেডিকেলের একটি আসন। আমাদের আজকের এই পর্বটি মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম বার কোনো কারণে ব্যর্থ হয়ে যারা দ্বিতীয় বারের জন্য চেষ্টা করবে তাদের জন্য। আজকের পর্বে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে বলে বিশ্বাসী আমরা। প্রশ্নগুলো:

  • সেকেন্ড টাইমাররা কি আসলেই চান্স পায় খুব একটা?
  • সেকেন্ড টাইমারদের কিভাবে প্রস্তুতি নেয়া উচিত?
  • ৫ মার্ক কাটা গেলে চান্স পাওয়াটা আরও কঠিন হয়ে যায় না?

এই প্রশ্নগুলোর পাশাপাশি আমরা আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর জানব আমাদের আজকের সাক্ষাৎকার পর্বে। আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানব একজন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীর থেকেই যিনি সেকেন্ড টাইম ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে সাদা অ্যাপ্রোন, গলায় স্টেথোস্কোপ।

আমাদের আজকের সাক্ষাৎকার দাতা:

শাহ ফরান শাকিব
শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর।

সাক্ষাৎকার পর্ব ০২

পাঠগৃহ: আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?

শাহ ফরান: ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

পাঠগৃহ: আলহামদুলিল্লাহ, আমিও ভালো। আমাদের পাঠকদেরকে সময় দিতে রাজি হওয়ায় ধন্যবাদ আপনাকে।

শাহ ফরান: আপনাকেও ধন্যবাদ আমাকে অনুজদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার সুযোগ করে দেয়ায়।

পাঠগৃহ:  তাহলে শুরু করা যাক মূল ইন্টারভিউ?

শাহ ফরান: হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত।

পাঠগৃহ: মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন ঠিক কবে থেকে দেখতে শুরু করেছিলেন?

শাহ ফরান: একদম ছোটবেলা থেকেই যে ডাক্তার হব এমন স্বপ্ন ছিলোনা। কেবল  "My aim in life" রচনা লিখার সময় লিখতাম যে "I want to be a doctor in future"। ছোট থেকে ইচ্ছে ছিলো ইন্জিনিয়ারিং পড়ার। বিশেষ করে কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং। কিন্তু ডাক্তারি পেশার প্রতি আলাদা একটা আবেগ সবসময়ই ছিলো। কারণ আমার নানা একজন গ্রাম্য ডাক্তার ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই রোগীদের প্রতি ওনার ডেডিকেশন দেখে আসছি। তো মূলত কলেজ লাইফে যাওয়ার পরই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন খুব চেপে বসে মাথায়। আর তখন থেকেই এই স্বপ্নটা নিয়ে পথচলা শুরু হয়।

পাঠগৃহ: কলেজ জীবনের শুরু থেকে মেডিকেলের জন্য প্রস্তুতি নিতেন? নিলে কিভাবে নিতেন?

শাহ ফরান: ওরকম আলাদাভাবে মেডিকেল ওরিয়েন্টেড প্রিপারেশন নেয়া হতো না। কিন্তু মেডিকেল প্রশ্ন ব্যাংক এনালাইসিস করার চেষ্টা করতাম। কি টাইপের প্রশ্ন আসে মেডিকেলে সেগুলো দেখতাম। আর বায়োলজি পড়তে ভালোই লাগতো সবসময়। তো বায়োলজি টা গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করতাম।

পাঠগৃহ: এইচএসসির পর কিভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?

শাহ ফরান: কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে যাই এইচএসসি এক্সাম দিয়ে। যেহেতু কেবল মেডিকেল ইচ্ছে ছিলে সেহেতু মেডিকেল ওরিয়েন্টেড প্রিপারেশনই নিতে থাকি। টপিক ওয়াইজ পড়তে থাকি আর কোচিংয়ের এক্সামগুলো দিতে থাকি।

পাঠগৃহ: আমরা জানি প্রথমবার আপনি সুযোগ পাননি ভর্তি হওয়ার? এখানে কি সঠিক প্রস্তুতির অভাব ছিল? না কি ভাগ্য বলেই ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন?

শাহ ফরান: প্রস্তুতি যতটুকু সম্ভব নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। মোটামুটি ভালো প্রস্তুতিই ছিলো ওইবার। কিন্তু শেষদিকে এসে মনে হয়েছে নিজের কনফিডেন্সটা কমে যাচ্ছিলো। আর এটা একটা কারণ হতে পারে প্রথমবার চান্স না হওয়ার।

পাঠগৃহ: ফলাফলের পর কেমন মনে হয়েছিল? ভেঙ্গে পড়েছিলেন? না কি আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে পেরেছিলেন শুরু থেকেই?

শাহ ফরান: স্বাভাবিকভাবেই খারাপ লেগেছিলো অনেক বেশি। কারণ এটাই আমার একমাত্র টার্গেট ছিলো। কিন্তু হতাশ হয়ে পড়িনি। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখেছিলাম।

পাঠগৃহ: অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করেননি?

শাহ ফরান: করেছিলাম, ঢাবি, জাবি। জাবিতে ডি ইউনিটে নাম এসেছিলো। আর ওইদিকে ডেন্টাল এ সিরিয়াল ছিলো ২০০০+ যেটা থেকে আসতোনা। আর আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজে  রিটেনে এ চান্স হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়ে ISSB তে গিয়ে বাদ পড়তে হয়। পরে আর্মি মেডিকেল কলেজ, যশোরে ভর্তি হওয়ার সুযোগ ছিলো, কিন্তু আর ভর্তি হই নাই। সেকেন্ড টাইম মেডিকেল এক্সাম দেয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

পাঠগৃহ: সেকেন্ড টাইম মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার জন্য কিভাবে পড়াশুনা করতেন?

শাহ ফরান: প্রথমবার পরীক্ষার প্রস্তুতি আর পরীক্ষা দেয়ায় অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। সেগুলি কাজে লাগানোর চেষ্টা করতাম। কোচিংয়ে এক্সাম ব্যাচে ভর্তি হয়ে যাই। টপিক ওয়াইজ রেগুলারলি রিভিশন দিতে থাকি এবং এক্সামে অংশ নিই। বারবার বইগুলি রিভিশন দিতে থাকি এবং সেই অনুযায়ী প্রশ্নগুলি সমাধান করতে থাকি। সব আগের পড়াই ছিলো। এজন্য তেমন কোনে সমস্যা হত না। এক কথায় বলতে গেলে, সেকেন্ড টাইমে আমার সবচেয়ে বেশি কাজে দিয়েছিলে বার বার রিভিশান দেয়া, প্রশ্ন সলভ করা আর রেগুলার এক্সাম দেয়া।

পাঠগৃহ:যারা প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে কোনো কারনে সুযোগ পায় না তাদেরকে যদি একটু সাজেশন দিতেন। কিভাবে মনোবল ধরে রেখে পরেরবার ঠিকই চান্স করে নেয়া যায়?

শাহ ফরান: প্রথমেই নিজের ওপর কনফিডেন্সটা ধরে রাখতে হবে। এবার আমার কোনো কারনে হয়নি তাই বলে পরেরবারও চান্স হবেনা এমনটা ভাবা যাবেনা। এরকম ভাবলে নিজের আত্মবিশ্বাসটা হরিয়ে ফেলবে। আর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেললে ভালো প্রিপারেশন নেয়া কখনোই সম্ভব না। তাই প্রথমত নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো। আল্লার ওপর ভরসা রেখে আবার শুরু করো। সবময় পজিটিভলি চিন্তা করার চেষ্টা করতে হবে। সেকেন্ড টাইমে ৫ নাম্বার কেটেও চান্স হচ্ছে। এটা মাথায় আনতে হবে। প্রতিবছর মোটামুটি ১০০০ জনের মতো চান্স পেয়ে থাকে সেকেন্ড টাইমারদের থেকে, এমনটাই শোনা যায় এক্সামের পর। নেগেটিভ চিন্তাধারা থেকে দূরে থাকতে হবে। আর আশপাশে সবমসয়ই ডিমোটিভেট করার জন্য কিছু মানুষ থাকেই। এদের কথায় কান দেয়াই যাবেনা। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে আর সবসময়ই আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে।

পাঠগৃহ: সেকেন্ড টাইমারদের জন্য কত মার্ক কাটা হয়?নেগেটিভ মার্কিং কতটা ইফেক্ট ফেলে রেজাল্টে?


শাহ ফরান: ৫ নাম্বার কাটা যায় সেকেন্ড টাইম এক্সামে। তাই এটা আাগে থেকে মাথায় রেখেই ওইভাবে প্রিপারেশনটা নিতে হবে। আর একটা ভুল উত্তর দেয়ার জন্য ০.২৫ মার্ক করে কাটা যায়। তাই এই বিষয়ে সাবধান থেকেই অ্যান্সার করতে হবে। কারণ এরকম প্রতিযোগিমূলক পরীক্ষার জন্য ০.২৫ মার্ক অনেক বড় কিছু।

পাঠগৃহ: আর পড়াশুনার যে ব্যাপারটা! সেটা কিভাবে করতে হবে। এনি গাইডলাইন?

শাহ ফরান: প্রথমত রেগুলারিটি মেইনটেইন করতে হবে পড়াশুনায়। সেকেন্ড টাইম প্রিপারেশনের জন্য এনাফ টাইম পাওয়া যায়। তাই ধৈর্য্যটা ধরে রেখে পড়াশুনাটা রেগুলার চালিয়ে যেতে হবে। আর রেগুলার এক্সামগুলো কমপ্লিট করতে হবে। যেসকল জায়গায় এক্সামে ভুল হচ্ছে ওগুলো ফাইন্ড আউট করে ভালোভাবে সমাধান করে নিতে হবে।

পাঠগৃহ: সেকেন্ড টাইমাররা পুরো একবছর বেশি সময় পায় প্রিপারেশনের। এটা প্লাস পয়েন্ট। আবার ৫ মার্ক কাটা যায় এটা মাইনাস পয়েন্ট। এই দুইটা কি ব্যালেন্স ক্রিয়েট করে? না কি কোনো একদিকে পাল্লা বেশি ভারি থাকে?

শাহ ফরান: আমার মনে হয় সেকেন্ড টাইমাররা আরেকটু এগিয়ে থাকবে। আপনার প্লাস পয়েন্টের সাথে আমি আরেকটু যোগ করতে চাচ্ছি। যারা প্রথমবার মেডিকেলে এক্সাম দেয় তাদের সবার জন্যই সেটা জীবনের সবচেয়ে বড় এক্সামই থাকে। এজন্য কমবেশি নারভাসনেস কাজ করেই। আর এমন অনেকেরই নারভাসনেসের কারণে পরীক্ষটা খারাপ হয়েই যায়। কিন্তু সেকেন্ড টাইম এক্সামে প্রথমবারের মত এত ভয় থাকেনা। করণ তুমিতো অলরেডি এই এক্সামটা ফেস করে আসছো একবার। তুমি এক্সাম হলের কন্ডিশনটা বুঝে ফেলেছো। তোমার কাছে এখন কিছুই নতুন না। সবই তোমার চেনা। আর এদিক দিয়ে তুমি ফার্স্ট টাইমারদের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে যাবে।

পাঠগৃহ: শেষ করে দেয়ার আগে যদি আর কিছু বলার থাকে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে!

শাহ ফরান: অবশেষে যারা সেকেন্ড টাইম মেডিকেল এক্সাম দিবে তাদের উদ্দেশ্যে ৩টি উপদেশ থাকবে:
১। নিজের আত্মবিশ্বাসটা এক মুহুর্তের জন্যও হারিয়ে ফেলবে না।
২৷ সবসময় মহান আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে এগিয়ে যাও।
৩।নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু দাও যাতে এবার আর কোনো আফসোস না থাকে।
আল্লাহ ভরসা। তুমি পারবেই।

পাঠগৃহ: অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য, জাযাকাল্লাহ।

শাহ ফরান: আপনাকেও ধন্যবাদ। সেকেন্ড টাইমারদের উদ্দেশ্যে কিছু বালার সুযোগ করে দেয়ায়।

শেষ কথা

যারা সেকেন্ড টাইম মেডিকেল এক্সাম দিবে তাদের উদ্দেশ্যে:
১। নিজের আত্মবিশ্বাসটা এক মুহুর্তের জন্যও হারিয়ে ফেলবে না।
২৷ সবসময় মহান আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে এগিয়ে যাও।
৩।নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু দাও যাতে এবার আর কোনো আফসোস না থাকে। আল্লাহ ভরসা। তুমি পারবেই। 
৪। বারবার পড়া, এক্সাম দেয়া, নিজের লিমিটেশন জানা এবং সলভ করা। 

 - শাহ ফরান শাকিব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর।

Md. Rabiul Mollah

Okay! So here I'm Md. Rabiul Mollah from Pathgriho Network. I'm currently a student of B.Sc in Textile Engineering Management at Bangladesh University of Textiles. facebook instagram github twitter linkedin

Previous Post Next Post

এই লেখাটি আপনার সোশ্যাল মিডিয়া ওয়ালে শেয়ার করুন 😇 হয়তো এমনও হতে পারে আপনার শেয়ার করা এই লেখাটির মাধ্যমে অন্য কেউ উপকৃত হচ্ছে! এবং কারো উপকার করার থেকে ভাল আর কি হতে পারে?🥺